লঞ্চের ধাক্কায় ধ্বসে যাচ্ছে ভোলা শহর রক্ষা বাঁধ


পন্টুনবিহীন লঞ্চ ও মালবাহী ট্রলার নৌঙর ও দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় ধস দেখা দিয়েছে ভোলার শতকোটি টাকার প্রকল্পের শহর রক্ষা বাঁধে। বাঁধের বিভিন্ন অংশের সিসি ব্লক ধসে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে রাক্ষুসে মেঘনার ভাঙন। ফলে ভোলা শহরবাসীর মাঝে দেখা দিয়েছে আতঙ্কের ছাপ। খবর ঢাকা পোস্ট।
সরেজমিনে ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়ন তুলাতুলি বেড়িবাঁধ গোলদার বাড়ি এলাকার মেঘনার তীরে দেখা হয় ষাটোর্ধ্ব বয়সের ছিদ্দিক ব্যাপারীর সঙ্গে। মেঘনায় বসতবাড়ি ছয় ভাঙা দেওয়ার পর আশ্রয় নিয়েছেন বেঁড়িবাধের পাশে। বর্ষা শুরুর আগে নতুন করে শহর রক্ষা বাঁধারে ব্লক ধস দেখা দেওয়ায় নতুন করে ভাঙন-আতঙ্ক বিরাজ করছে তার মনে।
তিনি বলেন, গাঙ্গে আইজতরি (এখন পর্যন্ত) ছয় ভাঙ্গন দিছে। এখন থাহি বেড়ির কানিত। বান বাইরসা (বর্ষা) আইনে আগে ডরে ডরে থাকতে ওইত, এই বুঝি আবার ঘরডা গাঙ্গে নিল। এই কয়ডা বছর শান্তিতেই আছিলাম এহন আবার হেই ভাঙ্গন। মেঘনা কি আমাগোরে ছারবো না।
একই কথা বলেন শাহাবুদ্দিন ভুলাই। তিনি বলেন, মেঘনায় ভাংগতে ভাংগতে আমাগোরে নিঃস্ব কইরা দিছে। ভাঙ্গন দেহাদিলেই গাড়ি দিয়া এই মন্ত্রী আয়, এমপি আয়। নদীর পারে হারা দিন মেম্বার-চেয়ারম্যানরা পইরা থাহে। পরে কয় বস্থা বালু দিয়া যায়। এই বালুর বস্তা নদীর ঢেউ আর লঞ্চের ধাক্কায় দুইদিন পরেই যেম তার হেমন হইয়া যায়।
শুধু ছিদ্দিক ব্যাপারী ও শাহাবুদ্দিন ভুলাই নন, এমন ভাঙন-আতঙ্কে দিশেহারা মেঘনাপাড়ের কয়েক লাখ মানুষ।
জানা যায়, প্রাকৃতিক গ্যাস-সমৃদ্ধ দ্বীপ জেলা ভোলাকে মেঘনার ভাঙন ঠেকাতে ১৯৯৮-২০০৪ সালে দুই দফায় শহরের তুলাতুলি পয়েন্টে ৩ হাজার ৩০০ মিটার ব্লক বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এরপর কয়েক ধাপে নদীর তীর সংস্কার করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্লক ও জিও ব্যাগের অনেক ক্ষতি হয়।
সর্বশেষ ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসসহ একাধিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও উচ্চ জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত ওই দুই কিলোমিটার ব্লক বাঁধের আরও ক্ষতি হয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাব ও এই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পন্টুনবিহীন লঞ্চ ও মালবাহী ট্রলার নোঙর করায় তার ধাক্কা সিসি ব্লকের ধস নেমে যায়। একপর্যায় ব্লকের সঙ্গে সঙ্গে মাটি বের হয়ে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শহরের ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতুলি এলাকার মেঘনার হার্ড পয়েন্টে প্রায় ৯ থেকে ১০ স্থানে ব্লক বাঁধের ধস সৃষ্টি হয়েছে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
তাদের অভিযোগ, ধসে যাওয়া বাঁধে নতুন করে ব্লক না দিয়ে বালুভর্তি বস্তা ফেলে নামকাওয়াস্তে সংস্কার করা হয়েছে। ফলে কয়েক মাস পরই আবার তা ধসে যাচ্ছে। দ্রুত সংস্কার না হলে আসছে বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভেঙে ভোলা শহরে পানি ঢোকার আশঙ্কা রয়েছে।
স্থানীয় নাছিম মিয়া বলেন, গত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে টেকসই ব্লক বাঁধের কারণে এলাকার ভাঙন বন্ধ ছিল। কিন্তু বর্তমানে বাঁধে ভাঙন সৃষ্টি হওয়ায় চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তারা। দ্রুত সংঙ্কার বা স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করা না হলে তুলাতুলি বাজারসহ ভোলার শহর হুমকির মুখে পড়বে।
এদিকে ধনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এমদাদ হোসেন কবীর জানান, ধনিয়া ইউনিয়নে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বসবাস, পানির স্রোতে নতুন করে তুলাতুলী মাছ ঘাট-সংলগ্ন মেঘনার হার্ড পয়েন্টে ব্লকের ধস দেখা দিয়েছে। ধনিয়ার পাশেই রয়েছে ভোলা পৌর শহর। আগামী বর্ষার আগে এই ব্লক ধসের সংস্কার না করা হলে ধনিয়া ইউনিয়নসহ ভোলা পৌর শহরে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অতিদ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)-১ সূত্র জানায়, বর্তমানে ভোলা শহর রক্ষা বাঁধের তুলাতুলি লঞ্চঘাট থেকে মুন্সিবাড়ি পর্যন্ত বাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৯ সালে এ শহর রক্ষা বাঁধের ২৫০ মিটার বাঁধ সংস্কারের জন্য অধিদপ্তরে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকার চাহিদা পাঠালে ৪৯ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। ওই টাকায় ঠিকাদার ৯ হাজার ৭২টি বালুভর্তি বস্তা (জিও ব্যাগ) ডাম্পিং করেছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পান-বুলবুল ও জলোচ্ছ্বাসে বাঁধের আরও ক্ষতি হয়। ব্লক ও বস্তা ধসে নষ্ট হলে ২০২০ সালে ভোলা পাউবো আবার ৭৯ কোটি টাকার চাহিদা পাঠায়। তবে বরাদ্দ হয় মাত্র ৭৯ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। এ টাকায় ১৫ হাজার ২৯৮টি বস্তা ফেলা হয়।
২০২১ সালে ইয়াসসহ একাধিক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও উচ্চ জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত ওই দুই কিলোমিটার ব্লক বাঁধের আরও ক্ষতি হয়েছে। এবার বাঁধটি সংস্কারের জন্য আট কোটি টাকা চাইলে এখনো কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
তবে ২০১৮ সাল থেকে ভোলা সদর উপজেলার ভাঙনকবলিত এলাকার মেঘনা নদীর তীর সংরক্ষণে অধিদপ্তরে ১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার প্রকল্প-নকশা একাধিকবার জমা দেওয়া হয়েছে।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান জানান, সদর উপজেলার তুলাতুলিসহ ঝুঁকিপূর্ণ নদীতীর সংরক্ষণের জন্য পাঁচ কিলোমিটারের একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে কাজ শুরু হবে। তুলাতুলী মাঝঘাট-সংলগ্ন এলাকার মেঘনা নদীর গভীরতা একটু বেশি ওই পয়েন্টটা আমাদের অবজারভেশনে রয়েছে। ঝুঁকি মনে হলে জরুরি ভিত্তিতে জিওব্যাগ ডাম্পিং করা হবে। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ বাকি অংশে জরুরি ভিত্তিতে জিওব্যাগ ডাম্পিংয়ের মাধ্যমে রক্ষার চেষ্টা করা হবে।
পন্টুনবিহীন লঞ্চ ও মালবাহী ট্রলার ঘাট দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তুলাতুলী লঞ্চ ও খেয়াঘাট ইজারাদার আসলাম গোলদার বলেন, ভোলা জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে ঘাট ইজারা নেওয়ার পর থেকে পন্টুনের জন্য বিআইডব্লিউটিএর কাছে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ দেই-দিচ্ছি বলে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো সুরাহা পাচ্ছি না।
তবে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাসানুজ্জামান বলেন, তুলাতুলীর এই পয়েন্ট দিয়ে পন্টুনবিহীন বিআইডব্লিউটিএর একাধিক লঞ্চ ঘাট করছে। ওই পয়েন্টে লঞ্চ ভেড়ার কারণে আমাদের জিওব্যাগ ও সিসি ব্লকের ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিআইডব্লিউটিএকে অবহিত করে চিঠি দিয়েছি, যাতে তারা এখানে পন্টুন ব্যবহার করে অথবা লঞ্চ ভেড়ানো থেকে বিরত থাকে।
এ বিষয়ে ভোলা বিআইডব্লিউটিএ কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম বক্তব্য দিতে নারাজ।
বর্ষা মৌসুমে উজানের পানি চাপে এই ভাঙন আরও ভয়াভয় রূপ নেবে, তাই দ্রুত সিসি ব্লক দিয়ে বাঁধ রক্ষায় ব্যবস্থা না নিলে হুমকির মুখে পড়বে শহর রক্ষা বাঁধ। তাই বর্ষা মৌসুমের আগেই জরুরি ভিত্তিতে বাঁধটি সংস্কার করার দাবি জানান স্থানীয়রা।
এসএমএইচ
