ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

Motobad news

মুনির হোসেন ছিলেন সাহসী সাংবাদিক, রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক মানুষ

মুনির হোসেন ছিলেন সাহসী সাংবাদিক, রাজনীতিক ও সাংস্কৃতিক মানুষ
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

এক কথায় মুনির হোসেন ছিলেন, বরিশালের আধুনিক সাংবাদিকতার পথিকৃত। ছিলেন রাজনীতিক ও সংস্কৃতিজন। উদার খোলামেলা এবং আন্তরিক এই মানুষটি মাত্র ৪৩-বছর বয়সেই আমাদের কাঁদিয়ে ২০০৬ সালের ২৫ নভেম্বর হঠাৎ করেই চলে গেলেন। হঠাৎ-ই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার এই আকস্মিক চলে যাওয়ায় অনেকেই ব্যথিত আজও। কেননা, সে কলম হাতে ছিলেন আমাদের সমাজের বিবেক। আর তার হাতের কলমই ছিল জ্বলন্ত মশালের আগুনে আঁধার চেরা আনন্দ। এই আনন্দকে পুঁজি করেই বরিশালের এক সময়ের বহুল আলোচিত সাপ্তাহিক সংবাদপত্র লোকবাণী পত্রিকায় সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়েছিলো গত শতাব্দীর আশির দশকে। তার লেখা প্রতিটি প্রতিবেদনই নাড়িয়ে দিত পাঠকের মন, কাঁপিয়ে দিত সমাজের সকল কলুষতাকে। রাজনীতিবিদ এবং সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব হিসেবেও সে ছিলেন পুরোটাই সফল, নাহলে কেনই বা আজও এতো মানুষ তার গুণমুগ্ধ হয়ে আছেন। 

এ্যাডভোকেট নেহাল হোসেন ও খালেদা বেগমের জ্যেষ্ঠপুত্র মুনির হোসেনের জন্ম ১৯৬৩ সালের আগস্ট মাসে। বরিশাল নগরীর ব্রজমোহন বিদ্যালয় (বিএম.স্কুল) থেকে এসএসসি এবং ব্রজমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি ও ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন। বলা যায়, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং পাকিস্তানী এ-দেশীয় হায়নাদের প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, তার প্রতিটি লেখনিতে। কেননা, মুনির হোসেনের আগুনঝরা সেইসব লেখনীর মুখে প্রবাহিত হত তার সমস্ত প্রতিবাদী সত্তা ও আবেগের স্রোতস্বিনী নদী। কখনো তরবারির চেয়েও ক্ষুরধার ছিল তার কলমের যুক্তি ও মুক্তির একেকটি ঢেউ। সেইসব ঢেউ যেন সারিবদ্ধ হয়েই পল্লবিত হয়েছে, যতোক্ষণ না প্রতিপক্ষ নির্দিষ্টভাবে পরাস্ত হয়েছে- চুরমার করা ভাঙনেরর ধাক্কায়। কিংবা নানা যুক্তি ও আবেগের দ্বিমিশ্রিত ভাষায় পরিবেশিত হয়েছে তার লেখার অঙ্গার ও আগুন। এভাবেই বারংবার সে উচ্ছ¡সিত হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতি ও ঔদাসীন্যের প্রতিবেদন লিখে। 

দ্দধু সাংবাদিকতায়ই নয়, তিনি দীপ্তি ছড়িয়েছেন সম্পাদনায়ও। নিজে ‘ইতিবৃত্ত’ নামক একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন প্রকাশের মাধ্যমে। এটিও ছিল তার অন্যতম কাজ। নব্বই দশকের রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক আঙ্গনে অভাবনীয় সাড়া তুলেছিল ম্যাগাজিনটি। যদিও তার মৃত্যুর পর ইতিবৃত্ত’র প্রকাকাশনা দীর্ঘদিন বন্ধই ছিল। তবে, সম্প্রতি এটি আবার, তারই অনুজ ভাই এস এম জাকির হোসেনের আন্তরিক উদ্যোগে দৈনিক মতবাদ-এর সাপ্তাহিক সাব্লিমেন্ট হিসেবে প্রকাশিত হচ্ছে এবং এটি এখন নিয়মিত দৈনিক মতবাদের সম্মানিত পঠকদের জন্য ফ্রি বিতরণ করা হয়। 
   
মুনির হোসেন বরাবরই রাজনৈতিকভাবে দীক্ষিত ছিলেন সর্বত্রই মার্কসবাদের পক্ষে। হয়তো সে কারণেই, প্রথম জীবনে জাসদ-এর ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের সঙ্গে একনিষ্ঠ হয়ে কাজ করেছেন। পরে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন, এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে জনগণের আস্থার রাজনীতি করেছেন। মনেপ্রাণে মানুষছোঁয়া লড়াই-সংগ্রমে নিজেকে উৎসর্গের মনোভাব ছিল বলেই- তার রাজনৈতিক জীবনও নানা অভিধায় বিসৃত ছিল। বেঁচে থাকলে, রাজনীতিকেই হয়তো বলা যেত পরতো? তার স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার অন্যতম নিরাপদ সমভূমি। কিন্তু অসময়ের অকাল মৃত্যুই তার এই নিরাপদ জমিকে খুব বেশিদিন ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়নি। 

কবিতা পাঠ ও লেখার প্রতিও তার প্রচণ্ড ঝোঁক ছিল। তার কণ্ঠে ছিল দরাজ আবৃত্তির কণ্ঠস্বর। বরিশালের নাগরিক অঙ্গনের প্রতিনিধিত্বকারী ২৯টি সংগঠনের জোট বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ফলে, যে কোনও মূল্যেই সে- কবিতা আবৃত্তি, গান ও নাটককে ও এর সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে আমাদের সামাজিক আগ্রগতির পথে উজ্জীবিত রাখার চেষ্টায় বদ্ধপরিকর ছিলেন আজীবন।

সাপ্তাহিক লোকবাণী দিয়ে সাংবাদিকতা জীবন শুরু হলেও, বরিশালের প্রথম দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল এর প্রথম বার্তা সম্পাদক হিসেব দায়িত্ব পালন করেছেন। এক সময়ে দৈনিক প্রবাসী যখন খুলনা থেকে প্রকাশিত হতো তখন সেই পত্রিকার বরিশাল সংবাদদাতা ছিলেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের বরিশাল সংবাদদাতা ও জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠের বরিশাল প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেছেন। বরাবরই নেতৃত্বের আদর্শে উদ্বুদ্ধ একজন সংগঠক ও সাংবাদিক নেতা হিসেবে...১৯৯৫-১৯৯৬, ১৯৯৮-১৯৯৯ এবং ২০০১-সাল শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।   

ফলে, এ কথা নির্দিধায় বলা যায় যে, মুনির হোসেনের সময়কালে বরিশালের সাংবাদিক বিগ্রেডের সারিতে প্রথম কয়েকজন তরুণদের মধ্যে সেই ছিল তখন আধুনিক ও সমসাময়িক চিন্তার অন্যতম একজন। কেননা, তখানকার সংবাদপত্রের প্যারেড গ্রাউন্ডে তার আবস্থান খুব বেশি দিনের ছিল না বটে। কিন্তু তার স্বল্প সময়ের সাংবাদিকতা জীবনের আপসহীন স্বাতন্ত্র ও আধুনিক বৈশিষ্টের লেখালেখি, গণমানুষের রজনীতি ও সাংস্কৃতিক নানা কর্মকাণ্ড এবং তার জীবন ছোঁয়া সকল কীর্তিসমূহই- মৃত্যুর পরে আজও তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কেননা, তার রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে বিচরণের ফলে, আজও সে সমানভাবে সবত্রই আলোচিত এবং উল্লিখিত হয়েই আছেন। কিংবা, এ-ও বলা যায়, তার আনেক ভাল কাজের জন্যেই মৃত্যুর পরেও সে বেঁচে রয়েছেন আমাদের প্রত্যেকের বুকের পাঁজর দিয়ে তৈরি আন্তরের নিভৃত খাঁচায়।  

লেখক : কবি ও দৈনিক মতবাদের যুগ্ম সম্পাদক।       


এএজে
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন