ঢাকা শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Motobad news

৩ হাজার দরিদ্র মানুষের টাকা মেরে দিয়েছে পদ্মা ইসলামী লাইফ!

৩ হাজার দরিদ্র মানুষের টাকা মেরে দিয়েছে পদ্মা ইসলামী লাইফ!
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন

এক দিন রাস্তায় বের না হলে চাল কেনার টাকা থাকে না ভ্যানচালক মো. রুবেলের। তার চেয়ে খারাপ অবস্থায় দিন কাটছে বিধবা ছাহেরার। অন্যের বাড়িতে কাজ না করলে ভাত জোটে না। অভুক্ত থাকে সন্তানরা। এমন অনেক বিধবা নারী ও দিনমজুরসহ প্রায় তিন হাজার দরিদ্র মানুষের বিমা দাবির টাকা পরিশোধ করছে না পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।

অথচ বিমা করলে দ্বিগুণ লাভ পাবেন— গ্রামের অসহায় মানুষকে এমন স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন প্রাইম ইসলামী লাইফের কর্মকর্তারা। সরল বিশ্বাসে সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ পেতে প্রতিষ্ঠানটিতে ক্ষুদ্র সঞ্চয় ও একক বিমা করেন তিন হাজার দরিদ্র মানুষ। বিমাগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে পাঁচ বছর আগে। এখন লাভ তো দূরের কথা, আসল টাকাও পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, কোম্পানির অফিসও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে এমন ঘটনা ঘটেছে।


জানা গেছে, ২০১৬ সাল থেকে বিমা দাবির টাকা পেতে কোম্পানির পেছনে ঘুরছেন ভুক্তভোগী এসব গ্রাহক। টাকা উদ্ধারের আশায় প্রথমে তারা নীলফামারী জেলা অফিস, এরপর রংপুর বিভাগ এবং সর্বশেষ কোম্পানির প্রধান অফিসে ধরনা দেন। কাগজপত্রও জমা দেন, কিন্তু টাকা পাননি। শেষ ভরসা হিসেবে তারা এখন বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) দ্বারস্থ হয়েছেন। ভুক্তভোগী এসব গ্রাহকের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন কোম্পানিটিতে এজেন্ট হিসেবে কাজ করা ব্যক্তিরাও। কারণ, পাওনাদার গ্রাহকরা এজেন্টদের বাড়িতে প্রতিনিয়ত হানা দিচ্ছেন।

বিমা আইন অনুসারে, পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে গ্রাহকের দাবি পরিশোধ করতে হবে। যদি কোনো কোম্পানি নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হয় তাহলে বর্তমান ব্যাংকের সুদের চেয়ে বেশি হারে বিমা দাবির সুদ দিতে হয়। কিন্তু পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছে না।


প্রতিষ্ঠানটির সৈয়দপুর অফিসের এজেন্ট মমিনুল ইসলাম বলেন, ২০০৫ সালের শেষের দিকে কোম্পানিটির একটি সভা হয় সৈয়দপুরে। সভায় বিমা করলে দিগুণ লাভ পাওয়া যাবে বলে লোভ দেখানো হয়। এজেন্ট হিসেবে কাজ করলে অনেক টাকা উপার্জন করা যাবে, অল্পদিনে বাড়ি-গাড়ি করা যাবে বলেও স্বপ্ন দেখানো হয়। তাদের কথায় প্রথমে ১০ বছর মেয়াদি একটি ক্ষুদ্র বিমা করি। এরপর তাদের সঙ্গে এজেন্ট হিসেবে কাজ করা শুরু করি। প্রায় ৩০০ পলিসি করিয়েছি।

তিনি অভিযোগ করেন, প্রথম সাত-আট বছর অফিসার ফরিদ আহমেদ, মুকসেদ আলী এবং ঢাকা থেকে আসা অফিসার জাকির হোসেন ভালো ব্যবহার করেন। কিন্তু যখন আমাদের বিমাগুলো ম্যাচিউরিটির কাছাকাছি আসতে শুরু করে, তখন থেকে নতুন করে বিমা আনার জন্য চাপ দিতে থাকেন। আমরা কয়েকজন এজেন্ট রাত-দিন পরিশ্রম করে বিমা করিয়েছি। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০১৬ সাল থেকে যখন বিমা দাবি পরিশোধের জন্য বলি, তখন তারা টালবাহানা শুরু করেন। একবার বলেন, কাগজপত্র ঢাকা অফিসে পাঠিয়েছি। আরেকবার বলেন, কোম্পানির অবস্থা ভালো না, এখন টাকা দেওয়া যাবে না।

‘২০১৭ সালে ঢাকা থেকে আসা অফিসার জাকির হোসেন আমাকে বলেন, নতুন করে পলিসি আনলে পুরাতন দাবিগুলো দিয়ে দেব। তার কথা বিশ্বাস করে ২০১৭ সালে ১০-১২ জনকে ১২ হাজার টাকার একক বিমা করিয়েছি। এ বিমার প্রিমিয়াম নেওয়ার পর আজ পর্যন্ত আমাদের কোনো বিমা দাবির টাকা পরিশোধ করা হয়নি।’

তিন অফিসের স্যারদের পেছনে দৌড়াচ্ছি, কিন্তুটাকা পাচ্ছি না।তিন সন্তান আর আমরাদুজন; পাঁচজনের সংসারে আশা করেছিলাম জমানো টাকা দিয়ে কিছু একটা করব। কিন্তু তারা টাকা দিচ্ছে না। আমাদের মতো গরিবের টাকা মেরে খাচ্ছেন তারা
ভুক্তভোগী বিস্কুট বেকারির কর্মচারী মজিবর রহমান

এজেন্ট মমিনুল ইসলাম আরও বলেন, ‘প্রায় ৩০০ মানুষকে বিমা করিয়েছি। এখন সবাই আমার কাছে এসে টাকা চান। তাদের কারণে বাড়ি থাকতে পারছি না।’ তিনি কোম্পানির বগুড়া এবং রংপুর অঞ্চলের প্রধান ফরিদ আহমেদ ও মুকসেদ আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, ‘ঢাকা অফিস থেকে এরই মধ্যে ১২ গ্রাহক বিমা দাবির চেক নিয়ে এসেছেন। কিন্তু ওই দুজনের কারণে আমরা টাকা পাচ্ছি না। তারা টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে কোম্পানিও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’

বিমা দাবির টাকা না পাওয়া সৈয়দপুরের বিস্কুট বেকারির কর্মচারী মজিবর রহমান বলেন, একসঙ্গে মুনাফাসহ আসল পাব— এ আশায় প্রতি মাসে ২০০ টাকা কিস্তির ক্ষুদ্র সঞ্চয় বিমা করি পদ্মা লাইফে। ২০১৭ সালে বিমার মেয়াদ শেষ হয়। পরে টাকার জন্য রংপুর, ঢাকা, নীলফামারী— তিন অফিসের স্যারদের পেছনে দৌড়াচ্ছি, কিন্তু টাকা পাচ্ছি না। তিন সন্তান আর আমরা দুজন; পাঁচজনের সংসারে আশা করেছিলাম জমানো টাকা দিয়ে কিছু একটা করব। কিন্তু তারা টাকা দিচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, আমার পরিচিত সবাই এ কোম্পানিতে বিমা করেছেন। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এখন আর টাকা পাচ্ছেন না। আমাদের মতো গরিবের টাকা মেরে খাচ্ছেন তারা।


একই এলাকার বিধবা নারী ছাহেরা বলেন, আমি মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করি। সেখান থেকে কিছু টাকা জমিয়ে বিমা করি। যাতে শেষ বয়সে কিছু টাকা হাতে আসে। সন্তানদের নিয়ে চলতে পারি। কিন্তু টাকা তো পাচ্ছি না, এখন অফিসও হাওয়া হয়ে গেছে। আমার পক্ষে তো ঢাকা, রংপুর যাওয়া সম্ভব না। আপনারা আমার টাকার ব্যবস্থা করে দেন।

এ বিষয়ে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, আমি প্রতিষ্ঠানটিতে নতুন যোগ দিয়েছি। বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।

পাওনা টাকা পেতে গত ১৯ মে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে ভুক্তভোগী ৮১ গ্রাহকের পক্ষে মতি চন্দ্র, মজিবর রহমান, মমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগ দেওয়া হয়। সেখানে আইডিআরএ চেয়ারম্যানের কাছে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের প্রতিকার চাওয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘আমরা নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর উপজেলার গ্রাহক। আমরা গরিব অসহায় দিনমজুর, রিকশা ও ভ্যানচালক। ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের আশায় বিমা কোম্পানির চটকদার অফার ও মিষ্টি কথায় প্রলুব্ধ হয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছি। বিমার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর গচ্ছিত টাকা আদায়ে দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়ে বেড়াচ্ছি।


চিঠিতে বলা হয়, পদ্মা ইসলামী লাইফের নীলফামারী জেলার বিমাগ্রাহকের সংখ্যা প্রায় তিন হাজারেরও বেশি। ২০১৬ সাল থেকে অধিকাংশ বিমার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। কিছু বিমার মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে। এর মধ্যে পদ্মা লাইফ নীলফামারীর সব শাখার অফিস রাতারাতি বন্ধ করে পঞ্চগড় রিজিওনাল অফিসের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এতে নীলফামারী জেলার বিমাগ্রাহকরা ভোগান্তিতে পড়েন।

‘পাওনা টাকা আদায়ে পঞ্চগড়ে যোগাযোগ করলে তারা রংপুরে যেতে বলেন। রংপুরে গেলে প্রধান কার্যালয় ঢাকায় যোগাযোগ করতে বলেন। এভাবে সময়ক্ষেপণ করছেন তারা। টাকার শোকে অনেক বিমাগ্রাহক মারা গেছেন, অনেকে আবার চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। পদ্মা ইসলামী লাইফের প্রধান কার্যালয় পর্যন্ত ধরনা দিতে দিতে আমরা হতাশ হয়ে আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আপনি ইতোমধ্যে বিমার অনেক নতুন-পুরাতন জঞ্জাল পরিষ্কার করেছেন। এ সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। অনেক বিমা কোম্পানিকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করেছেন। আমরা প্রতারিত প্রায় তিন হাজার বিমাগ্রাহক আশা করি,পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কর্ণধারদের নীলফামারী জেলার মেয়াদোত্তীর্ণ গ্রাহকদের বিমার টাকা আদায়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবেন।’

এ বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান ড. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। হতদরিদ্র মানুষের বিমা দাবি যাতে দ্রুত পরিশোধ হয় সেই ব্যবস্থা নেব।’

বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করেন বিমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) প্রেসিডেন্ট শেখ কবির। তিনি  বলেন, ‘এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। কিছু বিমা কোম্পানির জন্য আমাদের সবার দুর্নাম হচ্ছে। আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ আসেনি। তবে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে যেহেতু অভিযোগ এসেছে, অবশ্যই তারা যথাযথ ব্যবস্থা নেবে বলে আশা করছি।’


এইচকেআর
গুগল নিউজে (Google News) দৈনিক মতবাদে’র খবর পেতে ফলো করুন