‘ইউরো’ আশিকসহ সাত সদস্যক গ্রেফতার


ঢাকার কেরানীগঞ্জের মো. আশিক এইচএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্যের পর মধ্যপ্রাচ্যে যায়। লিবিয়ায় দুই বছর অবস্থানের সময় মানবপাচার সিন্ডিকেটে জড়ায় আশিক। ২০১৯ সালে দেশে ফিরে কেরানীগঞ্জে থেকে মানবপাচার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয়। দুবাইয়ে থাকা মামা রুবেলের মাধ্যমে গড়ে তোলে ‘রুবেল সিন্ডিকেট’। রুবেলের মাধ্যমে অনলাইন ভিসা, বাংলাদেশি সংগ্রহ ও নৌপথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে দুবাইয়ে মানবপাচার করত আশিক।
চক্রটির মাদারীপুর, শরিয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিজস্ব এজেন্ট রয়েছে। প্রধান সমন্বয়ক আশিক আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে মানব পাচারের বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করত।
মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও ঢাকা থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে মানব পাচারের আন্তর্জাতিক চক্রের বাংলাদেশি এজেন্ট রুবেল সিন্ডিকেটের প্রধান সমন্বয়ক ‘ইউরো’ আশিকসহ সাত সদস্যকে গ্রেফতারের পর এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে র্যাব।
শনিবার (১০ জুলাই) রাত ১টা থেকে আজ রোববার (১১ জুলাই) সকাল ৬টা পর্যন্ত র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৮ এর যৌথ অভিযানে মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে।
গ্রেফতাররা হলেন, মো. আশিক (২৫), আজিজুল হক (৩৫), মিজানুর রহমান মিজান (৪৩), নাজমুল হুদা (৩১), সিমা আক্তার (২৩), হেলেনা বেগম (৪২) ও পলি আক্তার। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ১৭টি পাসপোর্ট, ১৪টি বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, দুটি এটিএম কার্ড, ১৫টি বিভিন্ন ব্যাংকে টাকা জমাদানের বই, দুটি হিসাব নথি, দুটি এনআইডি, ১০টি মোবাইল ফোন ও নগদ ৫৬ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।
রোববার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান, র্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, সম্প্রতি গত ২৮ ও ২৯ জুন অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরের তিউনিসিয়া উপকূলে নৌকা ডুবিতে প্রায় ৪৩ জন নিখোঁজ হয়। তিউনিশিয়ার উপকূলে বিধ্বস্ত নৌকা থেকে ৮৪ জনকে উদ্ধার করা হয়। তারমধ্যে বাংলাদেশ, সুদান, মিশর, ইরিত্রিয়া ও চাঁদের নাগরিক রয়েছে বলে জানা যায়। আজ আরও ৪৯ বাংলাদেশি উদ্ধারের সংবাদ জানা গেছে।
কমান্ডার মঈন বলেন, সম্প্রতি কয়েকটি মানব পাচারের ঘটনায় র্যাব মানবপাচার চক্রের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্রটি বিদেশি চক্রের সঙ্গে অবৈধভাবে ইউরোপে মানবপাচার করে আসছে। তিন ধাপে এ সিন্ডিকেট মানব পাচারের কাজ করে আসছিল।
বিদেশ গমনেচ্ছুদের নির্বাচন
বিদেশে গমনেচ্ছুদের নির্বাচনের সময় চক্রটির দেশীয় এজেন্টরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে উন্নত দেশে গমনের প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেকেই তাদের প্রস্তাবে সাড়া দেয়। বিদেশ গমনেচ্ছুদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ ও টিকেট ক্রয়সহ যাবতীয় কাজ সিন্ডিকেট নিজস্বভাবে সম্পন্ন করত। তবে পাসপোর্ট ও অন্যান্য নথি পাচার চক্রের নিয়ন্ত্রণে রেখে দেওয়া হতো। পরে তাদেরকে এককালীন বা ধাপে ধাপে কিস্তি নির্ধারণ করে ইউরোপের পথে পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ইউরোপ যেতে তারা ৭ থেকে ৮ লাখ টাকার অধিক অর্থ নেয়। সাড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা লিবিয়ায় যাওয়ার আগে এবং বাকি টাকা লিবিয়ায় যাওয়ার পর ভিকটিমের আত্মীয়-স্বজনের নিকট থেকে নেয়।
বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় প্রেরণ
চক্রটি বাংলাদেশ থেকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের মাধ্যমে লিবিয়া’ রুট ব্যবহার করছিল। মধ্যপ্রাচ্যে বিদেশি এজেন্টদের মাধ্যমে ভিকটিমদের নিয়ে ৭/৮ দিন অবস্থান করত। এই সময়ের ভেতরে লিবিয়ার বেনগাজিতে ভিকটিমদের পাঠানোর জন্য এজেন্টরা ‘মারাকাপা’ নামে একটি ডকুমেন্ট দুবাইয়ে পাঠাত। যা লিবিয়া যাওয়ার আগে দুবাইয়ে অবস্থানরত ভিকটিমদের হস্তান্তর করা হতো। ওই ডকুমেন্টসহ বিদেশি এজেন্টদের সহায়তায় তাদেরকে বেনগাজি পাঠানো হতো। লিবিয়া পর্যন্ত যারা অর্থ পরিশোধ করে তাদেরকে স্বল্প সময়ের মধ্যপ্রাচ্যে থেকে সরাসরি লিবিয়ায় পাঠানো হতো। প্রধান অভিযুক্ত রুবেল দুবাই বসে সিন্ডিকেটের সব কার্যক্রম মনিটরিং করে।
লিবিয়া থেকে ইউরোপ
পাচারের শিকারদের ত্রিপলিতে পৌঁছানোর পর লিবিয়ার এজেন্টদের সহায়তায় গাজী, কাজী ও বাবুল নামের তিন বাংলাদেশি তাদের গ্রহণ করত। ভিকটিমদের ত্রিপলিতে কয়েকদিন আটকে রাখা হতো। এ সময়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রতিনিধির দ্বারা ভিকটিমদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করত। এরপর ইউরোপে পাচারের উদ্দেশ্যে তাদেরকে হস্তান্তর করা হতো। কোনো এক ভোরে কয়েকটি নৌযান লিবিয়া হয়ে তিউনিশিয়া উপকূলীয় চ্যানেল ধরে ঝুঁকিপূর্ণ পথে ইউরোপের দিকে যাত্রা করত। ভূমধ্যসাগরে অনেক সময় দুর্ঘটনার শিকার হতো এবং জীবনাবসানের ঘটনাও অহরহ ঘটে।
গ্রেফতাররা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ভূমধ্যসাগরে বিগত কয়েকটি নৌকাডুবি ও গুলি করে হত্যার ঘটনায় নিখোঁজ ও নিহত বাংলাদেশিদের এই চক্র পাচার করেছে। চক্রটির মাধ্যমে ৭০ থেকে ৮০ জন বাংলাদেশি অবৈধপথে ইউরোপে পাচারের শিকার হয়েছেন। অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, রুবেল ২০১২-২০১৭ সাল পর্যন্ত লিবিয়া অবস্থানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। বর্তমানে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে মানব পাচারের ব্যাপারে রুবেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় তিনি দুবাইয়ে অবস্থান করে সিন্ডিকেটটি পরিচালনা করছেন। রুবেল বাংলাদেশে তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে মূল নেটওয়ার্ক পরিচালনা করছে। এ চক্রের কেন্দ্রে রয়েছেন রুবেলের স্ত্রী সীমা, রুবেলের ভাগিনা গ্রেফতার আশিক, দুই বোন হেলেনা ও পলি। গ্রেফতারকৃতরা পাসপোর্ট সংগ্রহ ও অর্থ লেনদেনে বিশেষ ভূমিকা পালন করত।
আর পুরো চক্রটির প্রধান সমন্বয়কের কাজ করছিল রুবেলের ভাগ্নে আশিক। সে এইচএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যায়। ২০১৯ সাল থেকে ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবস্থান করে মানব পাচারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। তার মূল দায়িত্ব ইউরোপে যেতে আগ্রহীদের বাংলাদেশ হতে দুবাই পাঠানো। এ চক্রের বাংলাদেশি সিন্ডিকেটে প্রায় ২০-২৫ জন সদস্য রয়েছে। চক্রটি বাংলাদেশের ভেতরে পাসপোর্ট বহনের ক্ষেত্রে কৌশলগত কারণে সাধারণত কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে থাকে।
কোটি কোটি টাকার লেনদেন
রুবেলের স্ত্রী সীমার একাউন্টে দেড় কোটি টাকা ও টালি খাতার তথ্যানুযায়ী আরও এক কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে। বিভিন্ন ব্যাংকে বেশ কয়েকটি একাউন্ট আছে বলে জানা গেছে। রুবেলের বোন হেলেনার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া চেক বইয়ের তথ্যানুযায়ী কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়েছে র্যাব।
এছাড়াও কয়েকজনের মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসা রয়েছে। গ্রেফতার হওয়া আজিজ মোবাইল ব্যাংকিং ও ইলেকট্রনিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তিনি মাদারীপুরে মাঠ পর্যায়ের বিদেশে গমনেচ্ছুদের নির্বাচন করে। গ্রেফতার মিজানের ওয়ার্কশপ ব্যবসা রয়েছে। গ্রেফতার মিজান মাঠ পর্যায়ে এজেন্টের সঙ্গে আঞ্চলিক এজেন্ট গ্রেফতারকৃত নাজমুলের সঙ্গে সমন্বয় করে থাকে। গ্রেফতার নাজমুল হুদাও মোবাইল ব্যাংকিং ও কসমেটিকস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাদারীপুর, শরিয়তপুর, মুকসুদপুর এলাকার আঞ্চলিক পর্যায়ের কার্যক্রম তদারকি করে। তারা এসব পেশার আড়ালে অবৈধ মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত।
এইচকেআর
