ঢাকায় বড় ভূমিকম্পের শঙ্কা কতটুকু?

আবু আনাস শুভম ॥
গতকালের (২১ নভেম্বর) ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি ছিল মূল আঘাত (Mainshock) এবং আজকের (২২ নভেম্বর) ছোট ছোট কম্পনগুলো (৩.৩ ও ৩.৭ মাত্রার) হলো আফটারশক (Aftershocks), যা প্রত্যাশিত ছিল।
এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া- বড় ভূমিকম্পের পর মাটির নিচের ফাটল বা ‘ফল্ট লাইন’ স্থিতিশীল হতে কিছুটা সময় নেয়, যার ফলে এই ছোট ছোট কাঁপুনি হয়।
তবে লক্ষণ ভালো: কম্পনগুলোর মাত্রা এবং তীব্রতা ধীরে ধীরে কমছে (৫.৭ ➡️ ৩.৩ ➡️ ৩.৭)। এটি নির্দেশ করে যে, মাটির নিচের শক্তি খরচ হয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিকের দিকে যাচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে আরও বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা কম।
তাৎক্ষণিক বড় ভূমিকম্পের গাণিতিক সম্ভাবনা (Statistical Probability): বৈজ্ঞানিক সূত্র (BathÕs Law Ges Omori Decay) বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, একই ফল্ট লাইনে ৬ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা ১% এরও কম। যদিও ছোটখাটো আফটারশক বা কম্পন আরও কিছুদিন চলতে পারে, তবে সেগুলোর মাত্রা ৪.৫ এর বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
এগুলো কেন Foreshock নয় বরং Aftershock?
আধুনিক সিসমোলজির (Seismology) সূত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, বর্তমান কম্পনগুলো মূলত ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পের আফটারশক। এর
পেছনে প্রধান ৫টি বৈজ্ঞানিক যুক্তি হলো:
১. ওমোরি ও বাথ-এর সূত্র (Omori's & Båth's Law ): বিজ্ঞানের এই দুটি সূত্র অনুযায়ী, আফটারশকগুলো সময়ের সাথে সাথে সংখ্যায় ও মাত্রায় কমে আসে। এখানে ঠিক তাই হচ্ছে- ৫.৭ এর পর ৩.৩ ও ৩.৭ মাত্রার কম্পনগুলো অনেক দুর্বল। যদি এগুলো বড় কোনো বিপদের পূর্বাভাস (Foreshock) হতো, তবে কম্পনগুলোর মাত্রা মূল ভূমিকম্পের খুব কাছাকাছি থাকত, এত কম হতো না।
২. একই স্থানে সীমাবদ্ধ (Spatial Footprint ): তিনটি ভূমিকম্পই মধুপুর ফল্টের একই ১০ কিলোমিটার এলাকার (Rupture Patch) মধ্যে হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে, নতুন কোনো ফাটল তৈরি হচ্ছে না, বরং ৫.৭ মাত্রার কম্পনে যে ফাটলটি নড়েছিল, সেটিই এখন স্থিতিশীল হচ্ছে বা ‘অ্যাডজাস্ট’ করছে (Afterslip )। ঢাকা নরম পলিমাটির (Alluvial Soil) ওপর অবস্থিত, যা ভূমিকম্পের ঝাঁকুনিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় (Basin Effect)।
৩. পরিসংখ্যানগত সম্ভাবনা (Base-rate Probability): ইউএসজিএস (USGS)-এর পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে মাত্র ৫% ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকম্পের পর তার চেয়ে বড় ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশের মতো ‘ইন্ট্রাপ্লেট’ (Intraplate) বা প্লেটের মাঝখানের এলাকায় এই সম্ভাবনা আরও কম (২-৩%)। অর্থাৎ, ৯৭-৯৮% সম্ভাবনাই হলো—সবচেয়ে খারাপ সময়টা পার হয়ে গেছে।
৪. বি-ভ্যালু বা চাপের নির্দেশক (b-value Analysis): বড় ভূমিকম্পের আগে সাধারণত মাটির নিচের ছোট ছোট কম্পনের অনুপাত বা ‘b-value’ কমে যায়, যা চাপ বাড়ার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু ঢাকার এই ঘটনায় ‘b-value ’ কমেনি বরং বেড়েছে। এর অর্থ হলো- মাটির নিচের চাপ জমা হচ্ছে না, বরং শক্তি নির্গত হয়ে চাপ কমে যাচ্ছে।
৫. পূর্বলক্ষণ বা প্রিকারসারের অভাব (No Precursors ): একটি বড় ভূমিকম্প আসার আগে সাধারণত কম্পনের হার হঠাৎ বেড়ে যায় বা কম্পনের কেন্দ্রস্থল (Hypocenter) সরে যেতে থাকে। এই ঘটনায় এমন কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ (GPS Anomaly বা কম্পন বৃদ্ধি) দেখা যায়নি।
বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি আছে কি? (Possibility & Risk )
স্বল্পমেয়াদী (আগামী কয়েক দিন): এখনই বা কয়েক দিনের মধ্যে এর চেয়ে বড় (যেমন ৭.০ বা ৮.০ মাত্রার) ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম (১% এর নিচে)। ছোট আফটারশক আরও কয়েক দিন হতে পারে, তাতে ভয়ের কিছু নেই।
দীর্ঘমেয়াদী (আগামী বছরগুলোতে): বাংলাদেশ একটি অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। ‘ডাউকি ফল্ট’ (সিলেট ও মেঘালয় সীমান্তে) এবং ‘প্লেট বাউন্ডারি’তে প্রচুর শক্তি জমে আছে। ভবিষ্যতে বড় মাত্রার (৭.৫+) ভূমিকম্পের ঝুঁকি বা ‘Big One’-এর আশঙ্কা অবশ্যই আছে, তবে সেটা কবে হবে তা নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব।
পরামর্শ:
১. ভয় পাবেন না: বর্তমান আফটারশকগুলো স্বাভাবিক। এগুলো বড় বিপদের ইঙ্গিত নয়, বরং মাটির নিচের ফাটল জোড়া লাগার প্রক্রিয়া।
২. প্রস্তুতি নিন: যেহেতু ঢাকা ঝুঁকিপূর্ণ জোন, তাই বাসার ভারী আসবাবপত্র (আলমারি, শেলফ) দেয়ালের সাথে আটকে রাখুন। কম্পন চলাকালীন-
দৌড়াবেন না: ঢাকার মতো বহুতল ভবনে কম্পন চলাকালীন সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করবেন না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভবন ধসের চেয়ে সিঁড়িতে তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই বেশি মানুষ আহত হন।
নিরাপদ অবস্থান: কম্পন শুরু হলে “Drop, Cover, Hold on” পদ্ধতি মানুন- মাটিতে নিচু হন, শক্ত টেবিল বা খাটের নিচে আশ্রয় নিন এবং শক্ত করে ধরে রাখুন। লিফট ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
ফাটল চিহ্নিতকরণ (Structural Check ):
গত দুই দিনের কম্পনে বাসায় কোনো ফাটল তৈরি হয়েছে কি না খেয়াল করুন। জানাল-দরজার কোণায় বা প্লাস্টারে সরু চুলের মতো ফাটল (Hairline crack ) ভয়ের কিছু নয়। কিন্তু যদি পিলার বা বিমে কোনো ফাটল দেখেন, বিশেষ করে ‘ঢ’ আকৃতির ফাটল, তবে দেরি না করে একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারের পরামর্শ নিন।
বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসছে, আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। মনে রাখবেন, ভূমিকম্প আটকানো সম্ভব নয়, কিন্তু সঠিক প্রস্তুতিই আপনার ও আপনার পরিবারের জীবন বাঁচাতে পারে।
তথ্য সূত্র: ঢাকা মেইল।
এইচকেআর