শেবাচিম হাসপাতালে নেই আইসিইউর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক


করোনায় আক্রান্ত গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসায় বরিশাল অঞ্চলের হাসপাতালগুলোর জন্য ১৯ এপ্রিল আরও ১৫টি আইসিইউ শয্যা এসেছে। এর মধ্যে বরিশাল শেরেবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালের জন্য সাতটি এবং ভোলা ২৫০ শয্যার জন্য ৩টি এবং পটুয়াখালী সদর হাসপাতালের জন্য ৫টি। এগুলো বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বসানো হয়নি। শেবাচিমের জন্য আরও ৫টি আসছে। তবে আইসিইউগুলোতে পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞ কোনো চিকিৎসক নেই বরিশালের কোথাও।
দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় দেড় কোটি মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল শেবাচিম হাসপাতালেও নেই আইসিইউর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। হাসপাতালের ডা. নাজমুল নামে যে একজন অ্যানেসথিওলজিস্ট রয়েছেন তিনিই এখন নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত করোনা ও সাধারণ মিলে ২৪টি আইসিইউ শয্যা দেখভাল করছেন। আইসিইউর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ঢাকা থেকে আসার সম্ভাবনাও নেই।
আইসিইউর রোগীদের সেবা দেয়া নিয়ে জানতে চাইলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলেছেন, ‘নার্সদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আইসিইউগুলো পরিচালনা করা হবে।’ অন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসকের কাজ নার্স দিয়ে হলে তো আর চিকিৎসকের দরকার পড়ত না।’ করোনার শুরু থেকেই আইসিইউ সংকটে বরিশালের রোগীরা। দক্ষিণের একমাত্র করোনা ডেডিকেটেড শেবাচিম হাসপাতালে ১২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। হাসপাতালে সাধারণ রোগীদের জন্য রয়েছে ১২টি আইসিইউ শয্যা। অ্যানেসথেসিওলজিস্ট ডা. নাজমুল হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের রোগী সামাল দেয়ার পাশাপাশি এ ২৪টি আইসিইউ শয্যাও সামাল দিচ্ছেন। অভিজ্ঞতা বলতে তার রয়েছে আইসিইউর উপরে ঢাকায় নেয়া ১০-১৫ দিনের প্রশিক্ষণ।
জানা গেছে, তিনি আবার কয়েকজন নার্সকে আইসিইউ ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এভাবেই আইসিইউ ওয়ার্ড চলছে। এর মধ্যে করোনা ভয়াবহ আকার ধারণ করলে শেবাচিমে বাসানো হয় আরও ১২টি আইসিইউ শয্যা। এগুলো দেখভালেরও দায়িত্ব ডা. নাজমুল ও তার টিমের ওপর। আশার কথা হচ্ছে, এ টিমের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে শেবাচিম হাসপাতালে এখন পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুহার দেশের অন্য যে কোনো স্থানের তুলনায় অনেক কম। তবে করোনা সামাল দিতে গিয়ে হাসপাতালের রুটিন অস্ত্রোপচারে ব্যাঘাত ঘটছে। দীর্ঘ হচ্ছে অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালে আসা রোগীর সারি। কথা হয় হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, ‘আরও ৩টিসহ নতুন ১২টি আইসিইউ আসার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’ বরিশালের মানুষের জন্য খবরটি খুশির সন্দেহ নেই। কিন্তু গুরুতর করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বলেন, ‘একদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। নিয়মিত দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসাবে ২৪টি আইসিইউ শয্যা চালাচ্ছেন ডা. নাজমুল। আরও যদি ১২টি আইসিইউ শয্যা আসে তাহলে সেগুলো চালাবে কে? একজন ডা. নাজমুলের পক্ষে নিশ্চয়ই এত আইসিইউ রোগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে না। আলাপকালে হাসপাতাল পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আইসিইউ বিশেষজ্ঞ চেয়ে আমরা বহুবার ঢাকায় চিঠি দিয়েছি। কোনো ফল হয়নি। বর্তমানে প্রস্তুতি নিয়েছি ৪০ নার্সকে আইসিইউ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার। তাদের দিয়েই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র চালানো হবে। কষ্ট হলেও ডা. নাজমুলকেই করতে হবে সুপারভিশন। এছাড়া তো উপায় নেই।’ একই সমস্যায় পড়েছে ভোলার ২৫০ শয্যা এবং পটুয়াখালী সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ২৫০ শয্যা হাসপাতালের জন্য ৩টি আইসিইউ শয্যা এসেছে। ভোলার সিভিল সার্জন ডা. সৈয়দ রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘বেডগুলো বসানোর জন্য ঢাকা থেকে লোক আসার কথা রয়েছে। তারা এলেই এগুলো বসানো হবে।’
পটুয়াখালী সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আব্দুল মতিন বলেন, ‘আমাদের এ হাসপাতালের জন্য ৫টি আইসিইউ বেড এসেছে ঢাকা থেকে। লোক এলেই বসানো হবে।’ আইসিইউ বিশেষজ্ঞ না থাকা অবস্থায় আইসিইউ বেডে ভর্তি হওয়া রোগীদের চিকিৎসা কি করে দেবেন জানতে চাইলে দুই কর্মকর্তাই বলেন, ‘পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে আমরা নার্স দিয়ে এগুলো চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাছাড়া আমাদের এখানে থাকা অ্যানেসথেসিয়ার ডাক্তাররা প্রশিক্ষণ নেবেন। এ মুহূর্তে চাইলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ তাই এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’
নার্স দিয়ে আইসিইউ চালানো সম্ভব কিনা জানতে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের ইনচার্জ ডা. কেএম বাকি বিল্লাহ বলেন, ‘অ্যানেসথেসিয়ার ডাক্তাররাই মূলত আইসিইউ চালায়। তবে এজন্যে তাদের আলাদা করে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। মোটামুটি স্ট্যান্ডার্ডর একটি প্রশিক্ষণের মেয়াদ কমপক্ষে ৩ মাস। তবে ১-২ বছরের প্রশিক্ষণও রয়েছে। নার্সদের কথা যদি বলেন তাহলে বলব আইসিইউর জন্য আলাদা করে প্রশিক্ষণ পাওয়া নার্স দরকার। তাছাড়া নার্সরা শুধু রোগীর অবস্থা মনিটর করে। কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে তারা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে জানাবে। ডাক্তার ব্যবস্থা নেবে। আইসিইউর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার অবশ্যই লাগবে। এছাড়া এখানে সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।’ পুরো বিষয় নিয়ে আলাপকালে বরিশালের স্বাস্থ্য বিভাগীয় পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার বলেন, ‘জরুরি পরিস্থিতির বিচারে সব নিয়ম মানা এ মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না। আমরা শেবাচিম হাসপাতালকে বলেছি ভোলা ও পটুয়াখালীর ডাক্তার এবং নার্সদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যাপারে সহায়তা করতে। এ সংক্রান্ত চিঠিও এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে। আইসিইউ বিশেষজ্ঞ না পাওয়া পর্যন্ত এভাবেই রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করছি আমরা।’
বরিশাল নাগরিক পরিষদের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ‘একা ডা. নাজমুল শেবাচিম হাসপাতালের ওটি এবং ২৪টি আইসিইউ বেড সামলাচ্ছেন। আবার নতুন আরও ১২টি আইসিইউ আসছে। এসব সামলানোর পর তাকেই যদি বলা হয় দুই জেলার ডাক্তার আর নার্সদের প্রশিক্ষণ দিতে তা হলে ফাইনালি কি হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’
টিএইচএ/
