ইচ্ছা পূরণের আশায় অশোক গাছে লাল সালু


পিরোজপুর সদর উপজেলার ডুমুরিতলা শ্রীগুরু সংঘ আশ্রমের একটি অশোক গাছের ডালে ইচ্ছা পূরণ করতে যুগ যুগ ধরে কয়েন সংবলিত লাল সালু বাঁধছেন দর্শনার্থীরা। আর ইচ্ছা পূরণ হলেই আশ্রমে দিয়ে যায় সামর্থ্য অনুযায়ী ভোগ। এরপর খুলে দিতে হয় সেই কয়েন বাঁধা লাল সালু। ৯০ বছরের পুরোনো এই অশোক গাছ নিয়ে এলাকাবাসীর কৌতূহল বহুদিনের।
জানা যায়, আশ্রমটির প্রতিষ্ঠাতা দুর্গা প্রসন্ন পরমাংসদেব এই গাছটি সযত্নে লাগিয়ে ছিলেন। তখন তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন শ্রীলঙ্কায় জন্মানো এই গাছটির মহিমা একদিন তোমরা বুঝতে পারবে। গাছটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গা প্রসন্ন পরমাংসদেবের এই ভবিষ্যদ্বাণী ক্রমশ সত্য হতে থাকে।
একদিন আশ্রমের সেবায়েত সুন্দরী মা গুরুদেবকে প্রশ্ন করেন, কী এই গাছের মহিমা গুরুদেব সেদিন তাকে বলেছিলেন , এই গাছে মনের ইচ্ছা ব্যক্ত করে বিশ্বাস ও ভক্তি সহকারে লাল সালু বাঁধলে গিরিধারী তা পূরণ করবেন। তবে সেই ইচ্ছা হতে হবে সৎ ও পবিত্র। আর যখন সে ইচ্ছা পূরণ হয়ে যাবে গাছে বাঁধা লাল সালু গিঁট খুলে দিয়ে মায়ের চরণে ভোগ দিতে হবে। এরপর একদিন সুন্দরী মা আশ্রমের অন্য সেবায়েতদেরও এ কথা জানালেন।
ভক্তবৃন্দ গুরুদেবের কথা মতো গাছে লাল সালু বাঁধতে শুরু করলেন। আশ্রমের সেবায়েতরা প্রত্যক্ষ করলেন ইচ্ছা পূরণ হওয়ার পর দূরদূরান্ত থেকে ফিরে আসছে ভক্তরা। এবং তারা তাদের বাঁধা লাল শালুর গিঁট খুলে ভোগ দিয়ে যাচ্ছেন আশ্রমে। মূলত তাদের মাধ্যমেই শাল সালু বাঁধা এ অশোক গাছের মহিমা ছড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে বিদেশেও। বিশেষ করে ফাল্গুনের ১ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়। তখন এই বৃক্ষটিও হয়ে ওঠে আরাধনার একটি পাঠ।
বছরের পহেলা ফাল্গুন মাঘী পূর্ণিমা জন্মাষ্টমিতে হাজার লোকের সমাগম হয় আশ্রমে। এ ছাড়া প্রতিদিনই শত শত দর্শনার্থী আসেন ইচ্ছা পূরণের জন্য এই আশ্রমে। তারাও তাদের মনোবাসনা পূরণের আশায় একটি পয়সা সহকারে লাল সালু বেঁধে রেখে যান অশোক গাছটির ডালে। ইচ্ছা পূরণের এই লাল সালু দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন লাল কৃষ্ণচূড়া ফুটে আছে গাছটি জুড়ে।
এ ব্যাপারে আশ্রমের প্রধান সেবায়েত কিশোর কুমার মালাকার বলেন, চব্বিশ বছর ধরে এই আশ্রমের সেবা করে আসছি। সেই থেকে দেখেছি দেশ-বিদেশের কত দর্শনার্থী এখানে আসেন। বিশ্বাস আর ভক্তি সহকারে এই অশোকের ডালে যেকোনো পয়সা লাল সালুর সঙ্গে বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে যান। অনেকে স্বপ্নাদিষ্ট হয়েও আসেন। আশা পূরণের পর বহু লোক এসেছে। প্রথা অনুযায়ী তারা গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা লাল সালুর গিঁট খুলে গাছের গোড়ায় রেখে মায়ের চরণে ভোগ দিয়ে গেছেন। আশ্রমের উন্নতির জন্য আর্থিক সহযোগিতাও দিয়েছেন।
আশ্রম কমিটির সদস্য সাজু চৌধুরী বলেন, প্রায় দুই একর জায়গাজুড়ে এই আশ্রমের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠেছে এই অশোক বৃক্ষ। ভক্তরা মনের বিশ্বাস থেকেই লাল শালু বেঁধে যান। এজন্য কোনো রকম আর্থিক লেনদেনের ব্যাপার নেই। ইচ্ছা পূরণের পর বাঁধন খুলতে যারা আসেন তারা আশাতীত সহযোগিতা দেন আশ্রমে। মূলত উপকারভোগীদের প্রচারণায়ই এর সুনাম ছড়িয়েছে। এমনকি ভারত থেকেও অনেকে আসেন এই গাছের ডালে লাল সালু বাঁধতে।
আশ্রমের গীতা স্কুলের শিক্ষক অভিজিৎ কুমার কর্মকার বলেন, ‘এই অশোক বৃক্ষে আমি নিজেই ইচ্ছা পূরণের আশায় লাল সালু বেঁধেছিলাম। গিরিধারীর কৃপায় আমার আশা পূরণ হয়েছে। এ ছাড়া আমার চোখের সামনে তিন মাস আগে এক মা এসেছিলেন। তিনি জানালেন, তার মেয়ে সুদূর আমেরিকা থেকে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তাকে এই অশোকের ডালে লাল সালু বাঁধতে পাঠিয়েছেন। বেঁধে যাওয়ার মাস দুয়েক পরে ওই মা আবার আশ্রমে আসেন। আশ্রমের জন্য অনেক উপঢৌকনও আনেন ও ভোগ দেন। তখন তাকে জিজ্ঞেস করি আপনার মেয়ের মনের আশা পূরণ হয়েছে? তিনি বলেন, হ্যাঁ হয়েছে।’
এই অশোক গাছ সম্পর্কে এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা শিখা রানী বলেন, ‘সম্পূর্ণ বিশ্বাসের ওপর ভর করেই ভক্তরা লাল সালু বাঁধেন। মাঘ মাসের পূর্ণিমা, শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন, ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহে হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়। ধর্মীয় বন্দনা, কীর্তন চলে দিনরাত সমান। এ ছাড়াও প্রতিদিনই দূরদূরান্ত থেকে যারা আসেন কেউ অভুক্ত ফিরে যান না। কোনো বাণিজ্যিক কারণ নয়। ধর্মকে লালন করাই এর মূল উদ্দেশ্য।’
এএজে
